হলে হলে ছাত্রলীগের মাদক বেচাকেনা - All News Paper

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Wednesday, February 7, 2024

হলে হলে ছাত্রলীগের মাদক বেচাকেনা

 রাজীব আহাম্মদ, জাবি থেকে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক বিভিন্ন হলে টর্চার সেল গড়ে তুলেছেন ছাত্রলীগের কয়েক নেতা। ধর্ষণ মামলায় সংগঠনের চার নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে নানা তথ্য। হলে হলে এসব কক্ষে চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন কারণে লোকজনকে আটকে রেখে নির্যাতন ও মাদক কারবার চলানো হয়।


গত শনিবার রাতে আশুলিয়ার এক দম্পতিকে ক্যাম্পাসে ডেকে এনে মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান ও বহিরাগত মামুনুর রশীদ মামুন। বিষয়টি জানাজানির পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে অবরুদ্ধ করেন মোস্তাফিজুর রহমানকে। তাকে পালাতে সহায়তা করায় আরও তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ধর্ষণের অভিযোগে মামলার দুই নম্বর আসামি মামুন পলাতক। মামলার পর জানা যাচ্ছে, ৪৫ বছর বয়সী মামুন প্রায়ই হলে থাকত; মোস্তাফিজুরের সঙ্গে মিলে ইয়াবার কারবার করত। ৩১৭ নম্বর কক্ষ ছিল ইয়াবা কারবারের কেন্দ্র।

মঙ্গলবার হলে হলে গিয়ে জানা গেছে, ছাত্রদের ১১ হলের অন্তত পাঁচটিতে টর্চার সেল আছে। বৈধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অবৈধ ও বহিরাগতরা এসব হলের কয়েকটি কক্ষকে মাদক কারবার, আটকে মারধর করে চাঁদা ও মুক্তিপণ আদায়ে ব্যবহার করে। এসব কক্ষকেই টর্চার সেল বলছেন শিক্ষার্থীরা। 


জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্র হলের মাত্র একটিতে কমিটি রয়েছে। বাকিগুলোতে কোন্দলের কারণে কমিটি হচ্ছে না। এসব হল নিয়ন্ত্রণ করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের অনুসারী ও আশীর্বাদপুষ্টরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রভোস্টদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ছাত্রলীগ নেতারাই করেন সিট বণ্টন।


ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয়ের ছোট ভাই আরমান খান যুব মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে থাকেন। ৪১ ব্যাচের শিক্ষার্থী যুবর ছাত্রত্ব শেষ হলেও তিনি চারজনের কক্ষে একাই থাকেন। এটি টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত। এ অভিযোগের বিষয়ে আরমান খানের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। ২০১৮ সালে আল-নাহিয়ান খান জয় ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৯ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন যুব, যা এখনও অব্যাহত। জাবি ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল তাঁর ঘনিষ্ঠ।


শিক্ষার্থীরা সিট না পেলেও মওলানা ভাসানী হলের ৩৪৯ নম্বর কক্ষ খালি পড়ে রয়েছে। মাদক সেবনে ব্যবহার করা হয় কক্ষটি। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগ নেতারা কক্ষটিতে আড্ডা জমান। তাই হল প্রশাসন ব্যবস্থা নেয় না। 


আন্দোলনের পর টর্চার সেলে তালা

শনিবার ধর্ষণের মামলার পর নিপীড়নমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গতকাল মঙ্গলবার নিপীড়নবিরোধী মঞ্চের ব্যানারে তৃতীয় দিনের মতো মানববন্ধন করেছেন তারা। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন মীর মশাররফের টর্চার সেল সিলগালা করেছে; ছাত্রত্ব শেষে অবৈধভাবে দখল করে রাখা কক্ষগুলোতে তালা লাগিয়েছে। তবে অন্যান্য হলে টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত কক্ষগুলো আগের মতোই রয়েছে। এদিকে আন্দোলন শুরুর পর ছাত্রলীগের অনেকে হল ছেড়েছেন।


গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারসংলগ্ন সড়কে মানববন্ধন থেকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি, অছাত্রদের হল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়। ধর্ষণ মামলার আসামিদের পালাতে সহযোগিতা করেছেন অভিযোগ তুলে প্রক্টর অধ্যাপক আ স ম ফিরোজ উল হাসান ও মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাব্বির আলমের পদত্যাগ চান আন্দোলনকারীরা। যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত সহকারী অধ্যাপক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদুর রহমান জনিকে চাকরিচ্যুতির দাবি জানানো হয়। 


বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধ

জাহাঙ্গীরনগরে বেড়াতে আসা বহিরাগতদের নির্যাতন, নারী অতিথিদের যৌন নিপীড়ন, ছিনতাই, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও আশপাশের দোকান থেকে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, যারা টর্চার সেল চালায়, তারাই এসব অপকর্ম করে। তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের পদধারী নেতা কিংবা নেতার অনুসারী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধ বাড়ছে। গণরুম-গেস্টরুম কালচার বন্ধ না করা এবং বিভিন্ন সময়ে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না করাই ‘ধর্ষক’ সৃষ্টির কারণ। ক্যাম্পাসের প্রতিটি হলেই মোস্তাফিজের মতো অনেকেই রয়েছে।


ছাত্রলীগের নেতাকর্মী সূত্রে জানা যায়, নৃবিজ্ঞান বিভাগের ৪৪ ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাব্বির হোসেন নাহিদ থাকেন শহীদ রফিক-জব্বার হলের ২০২ নম্বর কক্ষে। তাঁর বিরুদ্ধে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদাবাজি, মারধর, তুলে এনে মুক্তিপণ আদায় এবং ক্যাম্পাসে মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। একই অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ৪৪ ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী সম্পাদক মেহেদী হাসান জয়ের বিরুদ্ধে। তিনি মওলানা ভাসানী হলের ৩১৫ নম্বর কক্ষে থাকেন। তাদের কক্ষগুলো টর্চার সেল হিসেবে পরিচিতি। এসব ঘটনায় এই দুই নেতাকে বহিষ্কার করলেও পরে প্রত্যাহার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এ ছাড়া সহসভাপতি রাকিবুল ইসলামের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের দোকান থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। তিনি সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।


সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের আল রাজী সরকার ছাত্রলীগের উপছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক; থাকেন মীর মশাররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ২২০ নম্বর কক্ষে। এ কক্ষে মাদক সেবন, তুলে এনে মারধর ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ আছে।


শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক অসিত পাল থাকেন শহীদ সালাম-বরকত হলের ২১৪/এ কক্ষে। এক বহিরাগতকে নেশাদ্রব্য খাইয়ে মারধর করে ৪৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রভোস্ট, প্রক্টরিয়াল বডি, ছাত্রলীগ নেতা ও সাংবাদিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে কক্ষটি থেকে অপহরণ ও নির্যাতনে ব্যবহৃত সরঞ্জাম এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছিল। 


বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী পানধোয়া এলাকার ইন্টারনেট ব্যবসায়ী মমিনউল্লাহর কাছে দাবি করা পাঁচ লাখ টাকা না পেয়ে লাইনম্যান খায়রুলকে ক্যাম্পাসে এনে মারধরের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক শান্ত মাহবুব ও উপদপ্তর সম্পাদক হাসিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। দু’জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের শিক্ষার্থী। তারা এ ঘটনা মিথ্যা বলে দাবি করেছেন। 


তালুকদার নেটের মালিক তছলিম তালুকদারকে সাক্ষী মেনে হাসিবুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘এসব ঘটনা মিথ্যা। মিথ্যা অভিযোগ করায় আইনি ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলাম। পরে আর নিইনি।’ 


তছলিম তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সমকালকে বলেন, আমার সঙ্গে কিছু ঘটেনি। আমার কাছ থেকে এক ব্যবসায়ী লাইন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে দিয়েছিলেন। ঘটনা তার সঙ্গে। 


হাসিব ও শান্তর ভাষ্যমতো পুরো ঘটনাই মিথ্যা কিনা প্রশ্নে তছলিম তালুকদার বলেন, ‘ঘটনা সত্য, না মিথ্যা– বলব না। খবরের কাগজে যা ছাপা হয়েছিল, ওইটাই ঘটনা।’ ব্যবসায়ীকে তুলে এনে মারধরের খবর গত বছরের মে মাসে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। 


গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতাকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতির ভাই যুবর বিরুদ্ধে। এর আগেও বেশ কয়েকজন ১২৬ নম্বর কক্ষে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সাভার ও আশুলিয়ার স্থানীয় কেবল টিভি ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ী, মাদক কারবারি অনেকের আনাগোনা রয়েছে এই রুমে। 


হলে আটকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ হলেও বিচার করে না প্রশাসন। এ দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফ্রন্টের সংগঠক সোহাগি সামিয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ত্রাসের রাজত্ব চলছে। এটি একদিনে তৈরি হয়নি। অনেক দিনের ফলাফল মোস্তাফিজ দেখিয়েছে। একজন নবীন শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে শুরুর দিন থেকেই শারীরিক ও মানসিক টর্চারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কখনোই সমস্যার মূলোৎপাটন করতে চায় না, বরং জিইয়ে রাখতে চায়।


বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বায়ক আলিফ মাহমুদ বলেছেন, শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয়। বিভিন্ন হলে নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিরা অভিযোগ করলেও সমাধান পাওয়া যায় না।


বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আ র ক রাসেল বলেন, ধর্ষণ ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটায় অবৈধ শিক্ষার্থীরা। অবৈধ শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদালয়ে গণরুম তৈরি করে বিকৃত যৌনাচারের দীক্ষা দেয়। গণরুমে নবীন শিক্ষার্থীদের উলঙ্গ করে পর্নো দেখানো হয়; তাদের পর্নো দেখতে বাধ্য করা হয়। 


ছাত্রলীগ সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল সমকালকে বলেন, সংগঠনে অনুপ্রবেশ করে অনেকে নিজের স্বার্থ হাসিলে অপকর্ম করে। ছাত্রলীগ তা প্রতিরোধে কঠোর। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ামাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হয়। 


No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages