মিয়ানমার সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার পরিকল্পনা সমস্যা কমাবে না বাড়াবে? - All News Paper

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Wednesday, February 7, 2024

মিয়ানমার সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার পরিকল্পনা সমস্যা কমাবে না বাড়াবে?

 সৌতিক বিশ্বাস

বিবিসি সংবাদদাতা, বিবিসি নিউজ

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মিয়ানমারের সঙ্গে উন্মুক্ত সীমান্তে বেড়া দেওয়ার ঘোষণা দেন এক সপ্তাহ আগে।


তিনি বলেন, “ভারত ১,৬৪৩ কিলোমিটার (১,০২০ মাইল) বিস্তৃত এই সীমান্তটির সুরক্ষা ঠিক সেভাবে করবে, যেভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তের বেড়া দিয়ে করে এসেছে, যা এর দ্বিগুণ দীর্ঘ।”


কীভাবে বেড়া দেওয়া হবে এবং সেটা কতটা সময় সাপেক্ষ, সেটিও ব্যাখ্যা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।


তিনি আরও জানিয়েছেন, ভারত সরকার ছয় বছরের পুরনো অবাধ চলাচলের চুক্তি বাতিল করার বিষয়টিও বিবেচনা করবে।

এই চুক্তির আওতায় ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের একে অন্যের সীমান্তে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ভিসা ছাড়াই ভ্রমণের অনুমতি রয়েছে।


তবে সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কাজটিতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, পার্বত্য এলাকায় বেড়া দেওয়া প্রায় অসম্ভব।


ভারতের এই পরিকল্পনা সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলে আসা ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করতে পারে। পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সমস্যাও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

ভারতীয় সীমান্তের কাছে অবস্থিত মিয়ানমারের একটি গ্রাম।

কোন কোন অঞ্চলে বেড়া দেওয়া হবে?
সীমান্তের যে অংশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তাতে উত্তর-পূর্বের চার রাজ্য- অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরাম রয়েছে।

দু’টি বড় ঘটনার ফলে বেড়া দেওয়ার এই পদক্ষেপ বলেই মনে করা হচ্ছে।

প্রথমটি হলো, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে সংঘাত, যা ভারতের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই সংঘর্ষে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শহর পালেতওয়ার কব্জার দাবি জানিয়েছিল উপজাতীয় বিদ্রোহীরা। ফলে মিয়ানমার ও ভারতের মাঝে একটি প্রধান সড়ক বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, গত বছর মণিপুরে সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া জাতিগত সহিংসতা। মণিপুরের সঙ্গে মিয়ানমারের প্রায় ৪০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই ও সংখ্যালঘু উপজাতি কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষে ১৭০ জনেরও বেশি নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার মণিপুরেও ক্ষমতায় রয়েছে।

সরকার অবৈধভাবে প্রবেশকারী বিপুল সংখ্যক অভিবাসীদের বিষয়ে জানিয়েছে। এছাড়াও জানানো হয়েছে, মিয়ানমার থেকে মণিপুরে এসে বসতি স্থাপন করা প্রভাবশালী মাদক মাফিয়া এবং যারা আফিম চাষ করে তারা ওই সহিংসতাকে আরও উস্কে দিয়েছে।

গত জুলাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান সোয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন।

সে সময় তিনি বলেছিলেন, “ভারতের সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি গুরুতর।”

সেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে এমন কোনও পদক্ষেপ এড়ানো উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। এর পাশাপাশি তিনি মানব ও মাদক পাচার নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
গত বছর মণিপুরে শুরু হওয়া সহিংসতায় বহু মানুষ নিহত হয়।
মণিপুরের জাতিগত সহিংসতা ও মিয়ানমার
আমেরিকান থিংক-ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যানের মতে সীমান্তে বেড়া দেওয়ার পদক্ষেপটি ভারতের পূর্ব সীমান্তে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান দ্বিমুখী বিপদের কথা ভেবে নেওয়া।

তিনি বিবিসিকে বলেছেন, “মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের প্রভাব এবং সেখানকার অভিবাসীদের অশান্ত মণিপুরে প্রবেশের ঝুঁকি কমাতে চাইছে ভারত।”

কেউ কেউ অবশ্য এই কারণগুলির যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন।

মণিপুর সরকার যদিও এই সংঘাতের জন্য মিয়ানমার থেকে আসা কুকি শরণার্থীদের দায়ী করছে, সংশ্লিষ্ট কমিটি গত বছর এপ্রিলে রাজ্যটিতে মাত্র ২১৮৭ জন মিয়ানমারের অভিবাসীকে চিহ্নিত করে।

মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, “এর সপক্ষে যুক্তি আর প্রমাণ খুবই দুর্বল। কুকিরা বহু শতাব্দী ধরে মণিপুরে রয়েছে। সীমান্তে অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা মেইতেই এবং সমস্ত সম্প্রদায়ের জন্যই উপকারী। শুধু তাই নয়, এতে মেইতেইদের ব্যবসায়িকভাবেও লাভ হয়েছে।”
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের কারণে পালিয়ে আসা ৪০ হাজারেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে মিজোরাম।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ঘাঁটি
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা বলেন, “সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কারণ 'বেসামরিক নাগরিকদের প্রবেশ' নয়। এর কারণ, উত্তর-পূর্ব ভারতের একাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী গ্রাম ও শহরগুলিতে শিবির তৈরি করেছে।”

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল কয়েক দশক ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহে জর্জরিত।

সুরক্ষা বাহিনীকে এই অঞ্চলগুলিতে তল্লাশি চালানো এবং বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট)। অন্য সামরিক অভিযানের সময় বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর অভিযোগ থেকে বাঁচানো এই আইন অবশ্য বিতর্কিত।

ওই সেনা কর্মকর্তা বলেন, “মিয়ানমারে লুকিয়ে থাকা ভারতীয় বিদ্রোহীরা সহজেই সীমান্তে ঢুকে তোলাবাজি ও সহিংস কর্মকাণ্ড চালাতে পারে।”

তবে সীমান্তে বেড়া দেওয়ার এই পদক্ষেপের বিরোধিতাও হতে পারে।

ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, ভাষাগত ও জাতিগত বন্ধন রয়েছে এবং আনুমানিক ২০ লক্ষ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ মিয়ানমারে বাস করে।

'লুক ইস্ট' নীতি মেনে ভারতের সঙ্গে আরও নিবিড় অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে চায় মিয়ানমার।

ভারত তার 'লুক ইস্ট' নীতির আওতায় রাস্তাঘাট, উচ্চশিক্ষা, ক্ষতিগ্রস্ত প্যাগোডা মেরামতের জন্য মিয়ানমারকে দু’শ কোটি ডলার দিয়ে সাহায্য করেছে, যার বেশিরভাগটাই অনুদান।
গোলাগুলি চলার পর উত্তপ্ত পরিস্থিতি।
দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হলো, ওই সীমান্ত জাতিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে সম্পর্কিত মানুষকে পৃথক করে।

মিজোরামের মিজো ও মিয়ানমারের চিন জনগোষ্ঠীর মানুষেরা জাতিগতভাবে খুড়তুত বা চাচাত ভাই-বোন। তাদের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত সম্পর্ক রয়েছে। খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ চিন রাজ্য কিন্তু মিজোরামের সীমান্তবর্তী, আর সীমান্তের দু'পাশে নাগা রয়েছে।

অনেক নাগা মিয়ানমার থেকে ভারতে এসে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছে।

অরুণাচল প্রদেশের ওয়ালং থেকে চোরাশিকারিরা বহু শতাব্দী ধরে সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসে।

এটা খুব একটা আশ্চর্যজনক নয় যে, মিজোরাম কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের কারণে পালিয়ে আসা ৪০ হাজারেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।

বিজেপির জোটসঙ্গী তথা নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেইফিউ রিও সম্প্রতি বলেছিলেন, “মানুষের সমস্যার সমাধান করতে কীভাবে অনুপ্রবেশ বন্ধ করা যায় সে সম্পর্কে একটি ফর্মুলা তৈরি করতে হবে। কারণ নাগাল্যান্ড সীমান্ত ভাগ করেছে মিয়ানমারের সঙ্গে। সীমান্তের দুই পাশে রয়েছে নাগা।”

পাহাড় ও ঘন জঙ্গল দিয়ে সীমান্তে বেড়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও বেশ চ্যালেঞ্জ থাকবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বার্টিল লিন্টার বলেন, “সীমান্তের কাছে থাকা সব পাহাড় ও দুর্গম এলাকার কথা ভাবলে, পুরো সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া অসম্ভব। এটা কিন্তু ঠিক বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের মতো নয়।”

তিনি বলেন, "বেড়াটি অবাস্তব এবং তৈরি করতে বহু বছর লাগবে। আর যদি এটা কোথাও তৈরি করা হয়, তাহলেও স্থানীয় মানুষেরা এরমধ্যেও ঠিক রাস্তা তৈরি করে ফেলবে।”
ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত।





No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages