খুচরায় চালে কেজিতে ১০ টাকা, মাছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা - All News Paper

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Saturday, January 27, 2024

খুচরায় চালে কেজিতে ১০ টাকা, মাছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা

 চলতি মাসে চালের দাম হঠাৎ করে লাফ দেওয়ার পর সরকারি আরো সংস্থার যে দৃশ্যমান তৎপরতা, তার সবই পাইকারি বাজার কেন্দ্রিক। খুচরায় নেই নজর।

শুক্রবার কারওয়ানবাজারে এই দরে চাল বিক্রি হয়েছে। এলাকার দোকানগুলোতে দাম ছিল কেজিতে এখান থেকে ১০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি।
আবুল বাসার সাজ্জাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Jan 2024, 10:31 PM
Updated : 26 Jan 2024, 10:31 PM

সরকারি নানা চেষ্টার পরেও চালের বেড়ে যাওয়া দাম কমেনি এই সপ্তাহেও। এর মধ্যে পাইকারি ও খুচরা দামের মধ্যে কেজিতে ৯ থেকে ১০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি পার্থক্য চোখে পড়ছে।

সাবেক এক কৃষি সচিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, চালের মতো অপচনশীল পণ্যে পাইকারি ও খুচরা দরে এই পার্থক্য মাত্রাতিরিক্ত। একজন পাইকারি বিক্রেতা বলছেন, খুচরায় বড়জোর ৪ টাকা মুনাফা হওয়া উচিত।

তবে মাছের ক্ষেত্রেও মুনাফার হার আরো বেশি। পাইকারি থেকে খুচরায় দামের পার্থক্য ৪০ শতাংশেরও বেশি দেখা যাচ্ছে। যদিও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে যে আলোচনা, সেখানে বারবার আলোচনায় আসছেন মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা, খুচরা বিক্রেতাদের মুনাফার বিষয়টি নিয়ে সেভাবে কথা বলা হয় না।

শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পাইকারি দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, পাইজাম কেজি প্রতি ৫১ থেকে ৫৩ টাকা, বিআর-২৮ চাল ৫১ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সরু চালের মধ্যে মিনিকেট ৬৬ থেকে ৭২ টাকায় কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, নাজিরশালের দাম ৬৪ থেকে মান ভেদে ৭৮ টাকা।
কিলোমিটার তিনেক দূরে মহাখালীতে খুচরা দোকান নাহার স্টোরে বিআর-২৮ চাল ৬০ টাকা, পাইজাম ৫৮ টাকা থেকে ৬০ টাকা আর মিনিকেট ৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে দেখা গেল।

অর্থাৎ পাইকারি ও খুচরায় কেজিতে দামে পার্থক্য ৮ থেকে ১১ টাকা, শতকরা হিসাবে ১৮ শতাংশের বেশি।

জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে চালের দাম হঠাৎ লাফ দেওয়ার পর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি যে তৎপরতা শুরু হয়েছে, তার কোনো প্রভাব নেই বাজারে
তবে চলতি মাসে চালের দাম হঠাৎ করে লাফ দেওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সরকারি আরো সংস্থার যে তৎপরতা, তার সবই পাইকারি বাজার কেন্দ্রিক।

কারওয়ানবাজারের পাইকারি বিক্রেতা মোহাম্মদ রাসেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো কেজিতে ৪০ পয়সা থেকে এক টাকা লাভে চাল বেশি। খুচরায় ৩ থেকে ৪ টাকা লাভ করতে পারে। কেউ যদি ১০ টাকা লাভ করে তাহলে তা অতিরিক্ত হয়ে যায়। এটা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।”

সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খুচরা আর পাইকারিতে একটা গ্যাপ থাকেই। তবে এত বেশি পার্থক্য হওয়ার তো কথা না। 

“খুচরা পর্যায়ে অতিরিক্ত মূল্যের পেছনে যেসব কারণ, সেগুলো হলো সুশাসনের অভাব, বাজার তদারকিব অভাব। আরেকটা বড় বিষয় হচ্ছে চাঁদাবাজি। বাজারে গাড়ি ঢুকাতেও চাঁদা দিতে হয়, আবার বের করতেও দিতে হয়। সব জায়গায় চাঁদাবাজি চলে আসছে। আর সরকারও এসব বিষয়ে খুব সক্রিয় না।”
এক টাকা হলেও দাম কমানোর ‘চাপ’

কারওয়ান বাজারের পাইকারি এক দোকানি দাবি করেছেন, সরকারের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা এসে তাদেরকে বলেছেন, এক টাকা হলেও দাম কমাতে হবে। তবে তারা বাজারে সরবরাহকারী কোম্পানির প্রতিনিধিকে দাম কমানোর বিষয়ে প্রশ্ন করলে তারা এড়িয়ে যান।

কারওয়ান বাজারের মেসার্স সিটি রাইস এজেন্সির বিক্রেতা মো. জুবায়ের হোসেন বলেন, “সাগর, ডায়মন্ড ও আমিন কোম্পানি থেকে আমি মাল আনি। তারা দাম কমাবে কি না, তার কিছু জানায় না। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়।

“আসলে চাউলের ব্যবসাটা নষ্ট করে দিছে এই বড় বড় কোম্পানি। এদেরকে যদি কিছু করা যায়, তাহলে দাম কমবে। নাইলে আমার কাছে মনে হয় না দাম আর কমবে।”

একই বাজারে আল্লাহর দান এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা এম এ আউয়াল বলেন, “কয়েকদিন আগে মন্ত্রণালয় থেকে লোক আসছিল। আমাদের ভাউচার আর বিক্রির রেট চেক দিয়ে দাম কমানোর কোনো সুযোগ পেল না। পরে আমাদেরকেই বলল দাম কমাতে। আমরা বললাম, ‘আপনারাই বলেন কোনটাতে কত কমাব।’

“আসলে আমাদের কেনা বেশি এখানে তো কমানোর সুযোগ নেই। উনারাও বুঝতেছে বিষয়টা। পরে উনারা আমার দোকানে মিনিকেট চালে ১ টাকা কমালেন। এভাবে যে কয়েকটি দোকানে গেলেন নির্দিষ্ট কোনো চাউলে ঠিক এক টাকা কমিয়েছেন।”

তিনি বলেন, “এখন আমার প্রশ্ন হলো এই নাটকীয় অবস্থা তৈরি করে কী লাভ? কিছু চাউলে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে সেখানে ১ টাকা কমালে কোনো লাভ নাই। তাই ধরতে হবে তাদেরকে যারা হুট করে দামটা বাড়াল।”

মাছে মুনাফা আরও বেশি

পুরান ঢাকার নয়াবাজারে পাঙ্গাস মাছের কেজি ২২০ টাকা শুনে দিনমজুর জীবন আহমেদ বললেন, “এটা (পাঙ্গাশ) আমগো গরিব গো শেষ ভরসা। এটার দাম এত হইলে খামু কী? কম দামে দেওন যাইব?”

দোকানি ২০০ টাকা পর্যন্ত রাখার প্রস্তাব দিলে জীবন ১৬০ টাকা বললেন। বিক্রেতা রাজি না হওয়ার পর জীবন মাছ না কিনে চলে গেলেন সবজির বাজারে।

সকালে কারওয়ান বাজারে এফডিসির পাশের রেলগেইট লাগোয়া পাইকারি মাছ বাজারে এক কেজি হিসেবে পাঙ্গাস ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায় কেনা গেছে। বেশি পরিমাণে কিনলে দাম আরো কম।

ঢাকার যেসব বাজার থেকে খুচরা বিক্রেতারা মাছ কিনে নেন, তার একটি এই বাজার। পাড়া মহল্লার বাজার থেকে এই বাজারে মাছের দামের পার্থক্য ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম বেশি দেখা গেছে।

এদিন কারওয়ান বাজারে যে রুই মাছ ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, নয়াবাজারে সে মাছ খুচরায় বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ কেজিতে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা বেশি। শতকরা হিসেবে পাইকারি ও খুচরায় পার্থক্য ৪০ শতাংশের বেশি।

কারওয়ানবাজারে মাছের আড়ত। এখানে খুচরাতেও বিক্রি হয় মাছ। দাম পড়ে অনেক কম
কারওয়ান বাজারে বড় আকারের যে গলদা চিংড়ি ১ হাজার ৫০ টাকা কেজি দেখা গেছে, নয়াবাজারে সেই মাছই দেখা গেছে ১৪০০ টাকা কেজি।

কারওয়ান বাজারে ছোট আকারের চাষের শিং দেখা গেছে ৩০০ টাকা, আবার বড় হলে তা হয় ৪০০ টাকা। এলাকার বাজারে তা ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা দাম চান বিক্রেতারা।

কারওয়ানবাজারে টাকি মাছ কেজি প্রতি ২৫০ টাকা, এক কিলোমিটার দূরে নিউ ইস্কাটনে সেই মাছ এক বিক্রেতা চাইছেন ৪৫০ টাকা কেজি, পরে ৪০০ টাকা পর্যন্ত নামতে রাজি হলেন।

নয়া বাজারে খুচরা বিক্রেতা নান্নু সিকদার বলেন, “চাষের শিং মাছ ৬০০ টাকা, দেশিটা ৮০০ টাকা। টাকির কেজি ৫০০।”

একই বাজারের চঞ্চল দাস বলেন, “পাঙ্গাস ২১০ থেকে ২২০ টাকা কেজি। আর ছোট সাইজের রুই ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি। যার কাছে যেমন পারা যায় বেচতাছি।”
নয়াবাজারের খুচরা মাছ বিক্রেতা আসলাম সিকদার যাত্রাবাড়ী আড়ত থেকে ১৪০ টাকা কেজিতে কিনে বিক্রি করেছেন ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে
পাশেই আসলাম সিকদারের নামে একজন পাঙ্গাস বিক্রি করছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বলেন, “আমার বক্তব্য নেন। আমি কম লাভ করি। সকালে যাত্রাবাড়ী আড়তে কেনা পড়েছে ১৪০ থেকে ১৪২ টাকায়। বেচি ১৫০ টাকায়।”

কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলে সামনে আগাতেই শোনা গেল তিনি দাম চেয়েছেন ২০০ টাকায়, নামতে রাজি হয়েছেন ১৮০ টাকা পর্যন্ত।

‘আপনি না বলছেন ১৫০ টাকা বেচেন?’- ফিরে গিয়ে এই প্রশ্ন করতেই আসলাম বলেন, “আপনি অন্য দোকানে দেখেন। আমার সময় আর নিয়েন না।”

অথচ এর আগে তিনি বলেছিলেন, “আমরা ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি মাছ আনি। লাভ খুব করি না। যে বেশি দামে বিক্রি করতেছে, সে নিয়ে আইছেই ১০ থেকে ১৫ কেজি।”

অর্থাৎ কম মুনাফা করার দাবি করছেন যে আসলাম সিকদার তিনিও দিনে এনে দিনে মুনাফা করছেন ৩০ থেকে ৪২ শতাংশ।

আসাদুজ্জামান নামে এক ক্রেতা দামাদামি করে ১৯০ টাকা দরে ৩ কেজি পাঙ্গাস কিনলেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চাষি কত দামে বেচে, পাইকারি দোকানিরা কত দামে বেচে, আর খুচরা দোকানিরা কত দামে বেচে, তা তো কেউ দেখে না। যদি তদারকি হত তাহলে যেমন খুশি তেমন দাম রাখতে পারত না। এত দাম দিয়েও আমাদের কিনতে হতো না।”
টাকা বাঁচে কারওয়ান বাজারে মাছের আড়তে

কারওয়ান বাজারের আড়তে খুচরাতেও মাছ বিক্রির কথা যারা জানেন, তারা কিছুটা কমে বাজার করতে পারেন।

ট্রাক চালক মো. মিলন মিয়া দেড় কেজি ওজনের একটি পাঙ্গাশ কিনে বললেন, “এখানে তো ১৬০ টাকা কেজিতে পাই। আর অন্য যে কোনো বাজারে ২০০ টাকা রাখবে।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মারুফ ভুঁইয়া দুই কেজি ওজনের রুই কিনে বলেন, “সব সময় এখান থেকেই মাছ কেনার চেষ্টা করি। অন্য জায়গার তুলনায় এখানে দাম কম পাই।”

কারওয়ানবাজারে এফডিসির পাশে রেলগেইট ঘেঁষা পাইকারি বাজারে খুচরাতেও মাছ বিক্রি হয়। নগরীর অন্যান্য এলাকা থেকে ৩০ শতাংশ বা তার চেয়ে কমে পাছ পাওয়া যায় সেখানে
ব্যবসায়ী মানিক রায় সপ্তাহের মাছের বাজার এখান থেকেই করেন। তিনি বলেন, “আজ এক কেজি বোয়াল কিনলাম ৬০০ টাকা দরে, আর পাবদা ৫০০ টাকা। এখানের দাম কম আর অনেক মাছ থাকায় পছন্দ করে নেওয়া যায়।”

কারওয়ানবাজারের আড়তদার মাকসুদ আলম বলেন, “রুই কেজি প্রতি ছোট সাইজের ২৮০ টাকা ও মাঝারি সাইজের ৩২০ টাকা আর একেবারে বড় সাইজ ৪০০ টাকা কেজি। গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে বাজার একটু বাড়তি। এখন তীব্র শীত। তাই ভোরে জেলেরা পানিতে নামে না। দেশি মাছও কম।”

রুই মাছের দোকানি জামাল আহমেদ বলেন, ভোর চারটা থেকে শুরু হয় পাইকারি বেচা কেনা। কিন্তু আমরা খুচরাতেও কিনতে চাইলেও দেই। মাছ থাকলে বিক্রি চলে ১০ টা থেকে সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত। এর ভেতরে বিক্রি শেষ না হলে বরফ দিয়ে রেখে দেন।


No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages