ছবি: রয়টার্স
দ্য ইকোনমিস্ট
প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ১৯:৩৬ | আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ১৯:৪০
৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল সংঘাতের পর ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠী সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। এরই মধ্যে তারা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়েছে। ১৬০টির মতো ড্রোন ও রকেট ছুড়েছে। ঘটনাস্থলের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে আহত হয়েছে। ২৮ জানুয়ারি তাদের এক হামলায় ৩ মার্কিন সেনা মারা গেছেন এবং ৩৪ জন আহত হয়েছেন। কোরিয়া যুদ্ধের (১৯৫০-৫৩) পর এই প্রথম আমেরিকান সেনাদের ওপর এ ধরনের হামলা চালানো হয়েছে। এর আগে স্থলে এমন ধ্বংসাত্মক বিমান হামলা চালানো সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে হামলার পাল্টা জবাব দিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
জো বাইডেন ও পেন্টাগনের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সামরিক কমান্ডের বিবৃতি থেকে জানা গেছে, আক্রমণকারীরা ‘টাওয়ার ২২’ সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে একমুখী ড্রোন হামলা চালিয়েছে। ফাঁড়িটি ছিল সিরিয়া সীমান্তঘেঁষা জর্ডানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একেবারেই শেষ সীমায়। একজন দাপ্তরিক কর্মকর্তার মারফত ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ড্রোন হামলায় আবাসিক ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০১৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ‘টাওয়ার ২২’ ফাঁড়িটি ব্যবহার করে আসছে। শুরুর দিকে এটি ছিল একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তারা সিরিয়ার শাসক বাশার আল আসাদ সরকারের বিরোধীদের এখানে ট্রেনিং দিত। পরে আইএসের বিরুদ্ধে কুর্দি বাহিনীকে সহায়তা দিতেও এর ব্যবহার হয়েছে। বলা হচ্ছে, ফাঁড়িটি ভালোভাবে সুরক্ষিত ছিল না। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল খুবই দুর্বল। এটি ছিল সিরিয়া সীমান্ত থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। তানফ এলাকায় ঘাঁটিটি সামরিক রসদ মজুতের দিক থেকেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে কয়েক হাজার মার্কিন সেনা ও তাদের মিত্ররা বাস করত।

৭ অক্টোবরের পর কয়েকবার ফাঁড়িটিতে হামলা হয়েছে। জর্ডান সরকার প্রকাশ্যে বলেছে, তাদের ভূখণ্ডে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি, তবে তানফের ঘটনাটি তারা স্বীকার করেছে।
জো বাইডেন বলেছেন, ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী সিরিয়া ও ইরাকে সক্রিয় রয়েছে। তারাই হামলা চালিয়েছে। দেশ দুটিতেই ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) অস্ত্র, সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিভিন্ন দল ইরাকে ‘ইসলামিক রেজিস্ট্যান্সের’ নামে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ সে দেশের সেনাবাহিনীতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছে। এতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডকে জটিল করে তুলেছে। এরই মধ্যে তারা মার্কিন ঘাঁটিগুলোয় বারবার ড্রোন ও রকেট হামলা চালি আসছে। গতকালের ঘটনার আগে গোষ্ঠীটি সবশেষ হামলা চালিয়েছিল ইরাকের পশ্চিমে আসাদ বিমান ঘাঁটিতে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র আটবার পাল্টা হামলা চালিয়েছে। যেমন– ২৩ জানুয়ারি ইরাকে বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এতে দেশটির জনগণ ইরাকের নির্বাচিত সরকারের কড়া সমালোচনা করছেন। ইরানিদের টার্গেট করে কয়েকটি অপারেশনও চালানো হয়েছে। ৮ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের জেট বিমান ‘আইআরজিসি’কে লক্ষ্য করে তাদের একটি অস্ত্রাগারে বোমাবর্ষণ করেছে। ১২ নভেম্বর একই বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও আবাসিক ভবনে হামলা চালানো হয়েছে। এসব ঘটেছে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে।
জো বাইডেন বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে লোহিত সাগরে একাধিকবার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন। এরই মধ্যে তিনি ইরান-সমর্থিত হুতিদের ওপর ৯ দফা হামলা চালিয়েছেন, যারা ইয়েমেনে বেশির ভাগ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বিভিন্নভাবে বৈশ্বিক জাহাজ চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে। ২৬ জানুয়ারি একটি তেলবাহী ট্যাঙ্ক আক্রমণের শিকার হয়েছে। ট্যাঙ্কটির মালিক ট্রাফিগুরা। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনার্জি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। হুতিরা এতে মিসাইল ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনাটি ঘটেছে এডেন উপসাগরে।
এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রবল হয়েছে। বিশেষত রিপাবলিকানরা ইরানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বারবার চাপ দিচ্ছেন। যুদ্ধবাজ সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম অভিযোগ তুলেছেন, বাইডেন প্রশাসন ইরানের ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকেছে। তিনি বলেছেন, ‘এক্ষুণি ইরানে হামলা চালাও।’ তাদের শক্তভাবে আক্রমণ করার অনুরোধও জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে বাইডেন পড়েছেন উভয় সংকটে। ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে মোটামুটি রকমের পদক্ষেপ নিলে তা অপর্যাপ্ত মনে হতে পারে, আবার বড় ধরনের পাল্টা হামলা থেকে অন্যান্য সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া ইরাকে বিশালাকৃতির আক্রমণ চালালে বাগদাদ সরকারের সঙ্গে তাদের তিক্ততা তৈরি হবে। এতে ইরান রাজনৈতিকভাবে জয়লাভ করবে।
ফলে ইরান অন্য জায়গায় এগিয়ে যেতে পারে। লেবাননে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ বাহিনী কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এদিকে ইসরায়েল ইরানে হামলা চালাতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রেরও উদ্বেগ রয়েছে। তারা মিত্রদেশটিকে সেখানে বড় ধরনের উত্তেজনা এড়াতে অনুরোধ করেছে। এতে ইরান হিজবুল্লাহকে আরও বেশি উৎসাহ দিতে পারে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন জায়গায় সরাসরি কিংবা প্রক্সি হিসেবে বড় পরিসরে হামলাও চালাতে পারে। এতে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে সামরিক ফাঁড়ি ছাড়াও কূটনৈতিক ও বেসামরিক ঘাঁটিগুলো।
বিভিন্ন প্রচেষ্টা থেকে মনে হচ্ছিল, যুদ্ধের অবসান ঘটবে কিংবা অন্ততপক্ষে উদ্বেগের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। তা ছাড়া যখন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদেশগুলো ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি চুক্তি মানাতে মধ্যস্থতা করছে, ঠিক তখনই আক্রমণের ঘটনাটি ঘটল। এতে নতুন করে উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল।
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
No comments:
Post a Comment